দুপুরের খাওয়ার পর শুভ তার প্রিয় শখের বাইসাইকেল নিয়ে বাড়ির পাশের মেঠো পথে বেরিয়েছিল। উদ্দেশ্য – বিলের ধার থেকে ঘুরে আসা। আকাশটা হালকা মেঘলা, রোদের তেজ কম। শুভ সাইকেল চালাতে চালাতে গুনগুন করে গান গাইছিল। হঠাৎই তার কানে এলো তীব্র কান্নার শব্দ। প্রথমে সে ভেবেছিল হয়তো কোনো বাচ্চার খেলাচ্ছলে কান্না। কিন্তু শব্দটা যতই তীব্র হতে লাগল, শুভর মন ততই খচখচ করতে লাগল।
সে বাইসাইকেল থামিয়ে শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে গেল। গ্রামের এক নির্জন পুকুর, চারপাশে ঝোপঝাড় আর কয়েকটি বাঁশের আড়। পুকুর পাড়ে কোনো মানুষজন নেই। শুভ দেখল, একটি লাল জামা পরা ছোট বাচ্চা জলের ধারে খেলছিল। কিন্তু সে খেলতে খেলতে কখন যে পুকুরের গভীর জলের দিকে চলে গেছে, তা কেউ খেয়াল করেনি। বাচ্চাটা হাত-পা ছুড়ছে আর জল খাওয়ার ফলে তার শরীর নীলচে হয়ে আসছে। সে আর পারছে না নিজেকে ধরে রাখতে।
শুভর সারা শরীর দিয়ে একটা হিমশটান বয়ে গেল। বাচ্চাটার বয়স তিন বছরের বেশি হবে না। এই নির্জন পুকুরে তাকে বাঁচানোর মতো কেউ নেই। মুহূর্তের মধ্যে শুভর মনে হাজারো চিন্তা ভিড় করল। সে কি পারবে? সাঁতার জানে ঠিকই, কিন্তু এত ছোট একটা বাচ্চাকে জল থেকে টেনে তোলা? গ্রামের মানুষরা কি ভাববে যদি সে ব্যর্থ হয়?
কিন্তু পরের মুহূর্তেই সব ভয় আর দ্বিধা উড়ে গেল। ছোট্ট একটা প্রাণ চোখের সামনে নিভে যাবে, এটা শুভ কিছুতেই মানতে পারল না। সে দ্রুত তার বাইসাইকেল একপাশে রেখে নিজের জামা খুলল এবং কোনো কিছু না ভেবেই পুকুরের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
ঠান্ডা জল শুভর শরীর স্পর্শ করতেই তার মনে এক অদ্ভুত জোর এলো। বাচ্চাটা জলের গভীরে প্রায় তলিয়ে যাচ্ছে। শুভ দ্রুত সাঁতরে বাচ্চাটার কাছে পৌঁছাল। বাচ্চাটার ছোট্ট শরীরটা তখন নিস্তেজ হয়ে গেছে। শুভ এক হাতে বাচ্চাটিকে সাবধানে ধরল এবং অন্য হাতে পাড়ের দিকে সাঁতরাতে লাগল। জলদি পাড়ে ওঠার জন্য তার সমস্ত শক্তি উজাড় করে দিল।
কয়েক মুহূর্ত পর, শুভ বাচ্চাটিকে নিয়ে হাঁসফাঁস করতে করতে পাড়ে উঠল। তার বুক ফেটে যাচ্ছিল, কিন্তু বাচ্চাটির প্রাণ বাঁচানোর এক অদম্য জেদ তার মধ্যে কাজ করছিল। পাড়ে তুলে শুভ দেখল বাচ্চাটার জ্ঞান নেই, শরীর ঠাণ্ডা। সে দ্রুত বাচ্চাটার পেটের জল বের করার চেষ্টা করল এবং বুকে চাপ দিতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর, বাচ্চাটা একটি কাশির শব্দ করে চোখ খুলল এবং কেঁদে উঠল।
সেই কান্না শুভর কানে যেন অমৃতের মতো লাগল। তার চোখ দিয়ে অনর্গল জল গড়িয়ে পড়ল। এতক্ষণে আশেপাশের কয়েকজন লোক চলে এসেছে। তারা যখন জানতে পারল শুভ একটি বাচ্চাকে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছে, তখন সবাই তার প্রশংসা করতে লাগল। বাচ্চাটার বাবা-মা এসে যখন তাদের সন্তানকে কোলে নিলেন, তাদের চোখের জল আর কৃতজ্ঞতা দেখে শুভর মনে হলো, এই মুহূর্তটাই তার জীবনের সেরা প্রাপ্তি।
সেই দিন শুভ শুধু একটি প্রাণ বাঁচায়নি, সে নিজের মধ্যে নতুন এক আত্মবিশ্বাস খুঁজে পেয়েছিল। সে বুঝেছিল, জীবন মানে শুধু নিজের জন্য বাঁচা নয়, অপরের জন্য কিছু করার মধ্যেও এক গভীর আনন্দ আছে। এই ঘটনার পর শুভ রাতারাতি গ্রামের হিরো হয়ে গেল। কিন্তু তার মনে একটাই চিন্তা – সে তার বন্ধু জয়ের সাথে মামার বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার জন্য তৈরি!